এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’র আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন টাইমস স্কয়ারে পারফর্মাররাই দর্শক-শ্রোতা! ডাইভারসিটি প্লাজায় উপচে পড়া ভীড়

এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’র আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন টাইমস স্কয়ারে পারফর্মাররাই দর্শক-শ্রোতা! ডাইভারসিটি প্লাজায় উপচে পড়া ভীড়

নিউইয়র্ক (ইউএনএ): নানা বাদ-প্রতিবাদ আর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে নিউইয়র্কে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামক সদ্যপ্রস্ফুটিত একটি সংগঠনের ব্যানারে শুক্রবার ও শনিবার (১৪-১৫ এপ্রিল) নিউইয়র্কে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা বর্ষবরণ-১৪৩০ উদযাপিত হলো। শুক্রবার সকালে ঐতিহাসিক টাইমস স্কয়ারে প্রথমবারের মতো পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। দ্বিতীয়দিনের আয়োজন ছিলো জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় দিনব্যাপী। ‘শতকন্ঠে ১৪৩০ বাংলা বর্ষবরণ’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে টাইমসস্কায়ারে মূলত: অনুষ্ঠানের পারফর্মাররাই ছিলেন দর্শক-শ্রোতা!। টাইমস স্কয়ারের যে স্থানে (৪৬ স্ট্রীট এন্ড ব্রডওয়ে) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সেখানকার গ্যালারি ছিলো দর্শক শূণ্য। অনুষ্ঠানে যোগদানকারী কারো কারো ফেসবুক-এর ভিডিও-তে তাই লক্ষ্য করা গেছে। অপরদিকে ডাইভারসিটি প্লাজায় ছিলো উপচে পড়া দর্শক-শোতাদের ভীড়। এদিকে আয়োজকরা জানান, পয়লা বৈশাখ উদযাপনের এই আয়োজনকে ব্যাহত করতে একটি মহল আদালতে মামলা করেছিলেন। ১৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেন। খবর ইউএনএ’র।

টাইমস স্কয়ারের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আগত ‘স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত’ বরেণ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ড. রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও প্রবীণ নৃত্যশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়লা হাসান ছাড়া প্রধান অতিথি নিউইয়র্ক সিটি মেয়র এরিক এডামস ও ইউএস কংগ্রেওম্যান গ্রেস মেং সহ অন্য কোন অতিথি প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলো না বলে জানা গেছে। তবে মেয়র সহ অতিথিগণ শনিবার (১৫ এপ্রিল) জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় আয়োজিত দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব তোফাজ্জল লিটন শুক্রবারের অনুষ্ঠান সামাপ্তি ঘোষণাকালে জানান। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে তোফাজ্জল লিটন এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’র প্রতিষ্ঠাতা ও এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ সাহা, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান ও মহীতোষ তালুকদার তাপসকে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেন।

টাইমস স্কয়ারের অনুষ্ঠানে মহীতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্ব ও পরিচালনায় সেখানে উপস্থিত প্রবাসীরা পহেলা বৈশাখ আর দেশের গান পরিবেশন করেন। এর মধ্যে নারীরা একই রংয়ের শাড়ী আর পুরুষরা একই রকমের পাঞ্জাবী পরে অংশ নেন। নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান গানের তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন। এছাড়াও সঙ্গীতানুষ্ঠানে একুশের পদকপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় প্রবাসের শিল্পীরা অংশ নেন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নানা ধরনের মুখোশের প্রতিচ্ছবি হাতে অংশগ্রহনকারীরা স্বল্প জায়গায় ‘তথা কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা’ প্রদর্শণ করেন। তবে অনুষ্ঠানস্থলে ‘উলুধ্বনি’ এবং শোভাযাত্রায় একজন পুরুষ আর একজন নারীর প্রতিকৃতির মুখোশ (কার, কেনো, কোন অর্থে ব্যবহৃত) স্থান পাওয়া নিয়ে কমিউনিটিতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। অপরদিকে অংশগ্রহণকারী নির্দিষ্ট জায়গায় ঘেরাও করে বসে অংশ নেয়ায় টাইমস স্কয়ারের কোন দর্শক-ই দেশী-বিদেশী) তাদের কোন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেননি। উলুধ্বনি’র ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরলে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। উল্লেখ্য, বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালী মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান সকলের সাংস্কৃতিক উৎসব হলেও ১৪ ও ১৫ এপ্রিলের অনুষ্ঠান উৎসবে অংশগ্রহনকারীদের অধিকাংশ ছিল একটি সম্প্রদায়ের। পবিত্র রমজানের কারণে অনেক মুসলমান স্বতস্ফুর্তভাবেই এই উৎসব ‘বয়কট’ করেছেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ছিলেন নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। তোফাজ্জল লিটনের সঞ্চালনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় তাঁর প্রীতি সম্ভাষণ দিয়ে। এসময় আরো বক্তব্য রাখেন পরিচালক মহিতোষ তালুকদার তাপস। ঠিক ভোর ৬টা ২০ মিনিটে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শতাধিক শিল্পীর অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় নতুন বাংলা বছরকে বরণের এ আয়োজনে কিছু প্রবাসীও অংশ নেন।

টাইমস স্কয়ারের অনুষ্ঠানে লায়লা হাসান বলেন, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালীর বড় প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে বহুজাতিক এ সমাজে বাঙালী প্রবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আবার তা প্রমাণিত হলো।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, টাইম স্কয়ারের শতকণ্ঠে বর্ষবরণের আয়োজনটি অনবদ্য। প্রবাস জীবনের এত প্রতিকূলতার পরেও বৈশাখের প্রথম দিনে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রবাসীদের বিপুল অংশগ্রহণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমার চাওয়া হচ্ছে, প্রতি বছর এভাবেই বৈশাখ উদযাপিত হোক নিউইয়র্কসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন, বিশ্বব্যাপী বাঙালী সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে এবারের পয়লা বৈশাখ উদযাপন যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার অংশগ্রহণে সর্বজনীনভাবে এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন আমাদের আগামী প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে।

এদিকে শনিবার দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে ডাইভারসিটি প্লাজায় ছিলো উপচে পড়া দর্শক-শোতাদের ভীড়। এদিন বিকেলে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দেন নিউইয়র্ক সিটি মেয়র এরিক এডামস। এছাড়াও ষ্টেট সিনেটর জন ল্যু, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক ড. নুরুন নবী, মূলধারার রাজনীতিক মোর্শেদ আলম, ব্যারিষ্টার সুমন, সহ অন্যান্য অতিথিরা। এই পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন সেমন্তী ওয়াহেদ। অনুষ্ঠানে মেয়রকে পাঞ্জাবী উপহার প্রদান আর উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়। সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বরেণ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কমলিনী মুখোপাধ্যায়, তাজুল ইমামসহ প্রবাসের জনপ্রিয় চন্দন চৌধুরী, শাহ মাহবুব, নিলীমা শশী, মারিয়া মৌ প্রমুখ শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে পরিচয় করিয়ে দেন মহীতোষ তালুকদার তাপসকে আর পরিচয় করিয়ে শিল্পী কমলিনী মুখোপাধ্যায়-কে পরিচয় করিয়ে দেন হাসান ফেরদৌস। নৃত্য পরিবেশন করেন প্রবীণ নৃত্যশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়লা হাসান। সন্ধ্যায় ইফতারের জন্য প্রায় এক ঘন্টা অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। আর ইফতারীর সময় পান্তা-ইলিশ খাবার ছিলো সবার জন্য ফ্রি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আর নানান প্রাণীর মুখোশ নিয়ে বিকেলে বের করা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।

এছাড়াও বিশিষ্ট টিভি নিউজ প্রেজেন্টার দিমা নেফারতিতির উপস্থাপনায় শ্রী চিন্ময় সেন্টারের শিল্পী ছাড়াও প্রবাসের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সঙ্গীত পরিষদ, সঙ্গীত সাধনা, বহ্নিশিখা সঙ্গীত নিকেতন, নৃত্যাঞ্জলী, ঢাকা ড্রামা’র শিল্পীরা সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। রাত ৯টার দিকে আয়োজক কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেন সাংবাদিক শামীম আল মামুন।

অনুষ্ঠানমালার মধ্যে আরো ছিলো একক ও যৌথ গান, নৃত্য, পঞ্চ কবির গান, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, আলোচনা, নাটক প্রভৃতি। উৎসবের থিম সং (সঙ্গীত) লিখেছেন সাংবাদিক ও ছাড়াকার দর্পণ কবীর, সুর করেছেন জাকির খান মজলিস আর কন্ঠ দিয়েছেন নাজমুল মুনিয়া ন্যান্সি। কোরিওগ্রাফি-তে ছিলো নৃতাঞ্জলী, পরিচালনায় ছিলেন চন্দ্রা ব্যানাজী। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিত সাহা।