ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ফলে উদ্ভূত পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কমিউনিটি রেডিও’র ভূমিকা
নিজস্ব প্রতিনিধি : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে কমিউনিটি রেডিও এখন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ-এর সম্মুখীন হচ্ছে। দিন দিন রেডিও’র শ্রোতা সংখ্যা কমে যাচ্ছে । তাই বর্তমান পরিবর্তিত সময়ে কমিউনিটি রেডিওকে টিকিয়ে রাখতে আশু করনীয় নির্ধারন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এন্ড কমিউনিকেশন(বিএনএনআরসি) উদ্যোগে ২-৩ আগস্ট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হলো ‘ডিজিটাল প্রযুক্তিগত পরিবর্তিত সময়ে কমিউনিটি রেডিও’র করনীয়’ শীর্ষক এক ধারাবাহিক অনলাইন কর্মশালা।
কর্মশালাটির মূল উদ্দেশ্য হলো- অন্তর্ভুক্তিমূলক কমিউনিটি সম্প্রচারের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ফলে উদ্ভূত পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্পর্কে আলোকপাত করা। কর্মশালায় দেশের ১৯ কমিউনিটি রেডিও এবং ২টি কমিউনিটি অনলাইন রেডিও’র মোট ৪২ জন স্টেশন ম্যানেজার ও সিনিয়ির সম্প্রচাকারীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
অংশগ্রহণকারী রেডিওগুলো হলো-কমিউনিটি রেডিও পদ্মা ৯৯.২এফএম ( রাজশাহী), কমিউনিটি রেডিও নলতা ৯৯.২এফএম ( কালীগঞ্জ , সাতক্ষীরা), কমিউনিটি লোকবেতার ৯৯.২এফএম ( বরগুনা), কমিউনিটি রেডিও পল্লীকন্ঠ ৯৯.২এফএম (মৌলভীবাজার), কমিউনিটি রেডিও সাগরগিরি৯৯.২এফএম (সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম), কমিউনিটি রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮এফএম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), কমিউনিটি রেডিও মুক্তি৯৯.২এফএম (বগুড়া), কমিউনিটি রেডিও চিলমারী৯৯.২এফএম (চিলমারী, কুড়িগ্রাম), কমিউনিটি রেডিও ঝিনুক ৯৯.২এফএম ( ঝিনাইদহ), কমিউনিটি কৃষি রেডিও ৯৯.৮এফএম ( আমতলী, বরগুনা), কমিউনিটি রেডিও নাফ ৯৯.২এফএম (টেকনাফ, কক্সবাজার), কমিউনিটি রেডিও সুন্দরবন ৯৮.৮এফএম(দাকোপ, খুলনা),
কমিউনিটি রেডিও বিক্রমপুর ৯৯.২এফএম (মুন্সিগঞ্জ), কমিউনিটি বরেন্দ্র রেডিও ৯৯.২এফএম ( নওগাঁ), কমিউনিটি রেডিও মেঘনা ৯৯.০এফএম (চরফ্যাসন, ভোলা), কমিউনিটি রেডিও সাগরদ্বীপ ৯৯.২এফএম (হাতিয়া, নোয়াখালী), কমিউনিটি রেডিও
সারাবেলা৯৮.৮এফএম (গাইবান্ধা), কমিউনিটি রেডিও বড়াল ৯৯.০এফএম ( বাঘা, রাজশাহী), কমিউনিটি রেডিও সৈকত ৯৯.০এফএম (কক্সবাজার), কমিউনিটি অনলাইন রেডিও দ্বীপ, কমিউনিটি অনলাইন রেডিও ভৈরব।
কর্মশালায় মূলত ৪টি বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়। বিষয়গুলো হলো- ভবিষ্যতের কমিউনিটি পরিচালনা বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা, অন্তর্ভুক্তিতার সাথে শ্রোতা সম্পৃক্তকরণ, আন্তঃশ্রেণিতে প্রভাব বিস্তার করা, কমিউনিটির অব্যবহৃত সম্পদ বা রিসোর্স মবিলাইজ করা বা কাজে লাগানো ।
মূল আলোচনা পর্ব পরিচালনা করেন জনাব এএইচএম বজলুর রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিএনএনআরসি এবং জনাব হীরেন পণ্ডিত, কর্মসূচি সমন্বয়কারী, বিএনএনআরসি । বজলুর রহমান ‘স্মার্ট বাংলাদেশে মিডিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক উপস্থাপনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন তুলে ধরেন। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান
ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ এলাকার মাত্র ৮.৫% শ্রোতা রেডিও শোনেন। অন্যদিকে, ২৯.৭% গ্রামীণ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমিউনিটি রেডিওর উপস্থিতির ওপর জোর দেন। নতুন প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে কমিউনিটি রেডিওগুলোকে কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায় এ বিষয়ক মুক্ত আলোচনা অধিবেশনে, অংশগ্রহণকারীরা ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়ে তাদের বর্তমান উদ্যোগ এবং তাদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
রেডিও পদ্মার স্টেশন ম্যানেজার মিস. সাহানা পারভীন বলেন, কমিউনিটি রেডিওগুলো কখনই পর্যাপ্ত বিজ্ঞাপন পায় নি, বর্তমানে বিজ্ঞাপনের সে হারও লক্ষণীয়ভাবে কমে যাচ্ছে। রেডিও লোকবেতারের স্টেশন ম্যানেজার জনাব মনির কামাল বলেন, আমরা ইতোমধ্যে মাঠ থেকে ভিডিও লাইভ অনুষ্ঠান শুরু করেছি এবং লোকবেতারের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সরাসরি সমম্প্রচার করেছি। কিন্তু এই সম্প্রচার কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সম্প্রচারকারীদের সংশ্লিষ্ট
প্রশিক্ষণ প্রদান আবশ্যক।
সম্প্রতি রেডিও সাগরগিরি তাদের ফেসবুক পেজে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং পর্যটনের উপর নিয়মিত ভিডিও ডকুমেন্টারি সম্প্রচার করেছে। স্থানীয় মানুষ এই ডকুমেন্টারিগুলো ভীষন পছন্দ করছেন এবং আগের তুলনায় রেডিও’র দর্শক বেড়েছে বলে জানান রেডিও সাগরগিরির স্টেশন ম্যানেজার সঞ্জয় চৌধুরী। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে কমিউনিটি রেডিও যদি স্থানীয় ইস্যুতে আঞ্চলিক ভাষায় মানসম্পন্ন ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে তাহলে রেডিওর দর্শক দিন দিন বাড়বে। আর এ জন্য অনলাইন রেডিওতে রূপান্তরিত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে জনাব মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন খান বলেন, কমিউনিটি
রেডিওর উদ্যোক্তা সংগঠনগুলো ডিজিটাল রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রেডিওতে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।
কমিউনিটি রেডিও মহানন্দা’র ফেসবুক পেজ ইতোমধ্যেই মনিটাইজেশনের আওতায় এসেছে জানিয়ে রেডিওটির সিনিয়র
টেকনিক্যাল প্রডিউসার জনাব রেজাউল করিম বলেন প্রতিটি কমিউনিটি রেডিওর নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব
চ্যানেল, ডেডিকেটেড নিউজ পোর্টাল এবং অনলাইন রেডিও অ্যাপ থাকা জরুরী। কিন্তু এগুলো পরিচালনা এবং মান সম্মত কন্টেন্ট তৈরি সংক্রান্ত উন্নত প্রশিক্ষণ ছাড়া এগোনো সম্ভব হবে না।
এ সময় রেডিও সারাবেলার স্টেশন ম্যানেজার গোলাপ মোস্তাফিজ বলেন- যেহেতু রেডিও’র স্বেচ্ছাসেবকদের কোন নিয়মিত বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না তাই আমরা তাদের কাছ থেকে কন্টেন্ট নিতে পারি । মান সম্মত কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে যেমন এই সকল স্বেচ্ছাসেবকদের ও আয় হবে তেমনি রেডিও’র সামাজিক মাধ্যমগুলোও মনিটাইজেশনের আওতায় আসবে।
এছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে সাথে সামঞ্জস্য রেখে কমিউনিটি রেডিও গুলোকে টিকে থাকতে হলে রেডিও’র ভিজ্যুায়ল ট্রান্সফরশেন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করা ছাড়া যে আর কোন বিকল্প নেই সে ব্যাপারে সকলেই একমত পোষন করেন। আশা করা হচ্ছে উক্ত কর্মশালার পরে, অংশগ্রহণকারী স্টেশন ম্যানেজার ও সম্প্রচারকারীগণসহ কমিউনিটি রেডিও’র অন্যান্য সদস্যরাও ডিজিটাল প্রযুক্তিগত পরিবর্তিত সময়ে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় কমিউনিটি রেডিও’র করনীয় সম্পর্কে রেডিও সংশ্লিষ্ট সকলে গভীর ভাবে চিন্তা করা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হবে।
উল্লেখ্য বিএনএনআরসি একটি গণমাধ্যম উন্নয়ন (Media Development) বিষয়ক সংস্থা যা ২০০০ সালে আত্ম প্রকাশ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে নিবন্ধিত। এটি জাতিসংঘের ইকোনোমিক এন্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (UN ECOSOC) এর বিশেষ পরামর্শক মর্যাদা প্রাপ্ত সংস্থা এবং সংস্থাটি তথ্য সমাজ বিনির্মাণে অবদানের জন্য ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (টঘ ডঝওঝ) জাতিসংঘের পুরস্কার-২০১৬ এর বিজয়ী এবং ২০১৭ এবং ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২৩- এর চ্যাম্পিয়ন । বিএনএনআরসি নলেজ-ড্রাইভেন মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট (কউগউ)-এর ভূমিকায় দেশীয় আঞ্চলিক, ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে কাজ করে থাকে। বিএনএনআরসির কর্মপ্রচেষ্টা হলো গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর তথ্য অধিকার, সুশাসন এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ-সুবিধাসমূহ বিবেচনায় রেখে জ্ঞানভিত্তিক ও চলমান ইস্যু বিবেচনায় রেখে গণমাধ্যমের উন্নয়ন।