অমাবস্যার জীবন – মাহমুদা সুলতানা

অমাবস্যার জীবন – মাহমুদা সুলতানা

গল্প
অমাবস্যার জীবন
– মাহমুদা সুলতানা

আজ কি পূর্ণিমা? ঠিক জানে না নীলা। ও জানে শুধু অমাবস্যার কথা।ওর জীবন জুড়ে এখন ঘোর অমাবস্যার বিষন্ন অন্ধকার। গনগনে চুলোর উত্তপ্ত আগুনের দিকে তাকাতে ভালো লাগে না। ভাত ফুটছে টগবগ করে। রাক্ষুসে খিদের মতো ভাতগুলো ছড়াচ্ছে এক ধরনের ঘোলাটে গন্ধ। এমন গন্ধ পছন্দ নয় নীলার। খিদেকে অস্বীকার করে না নীলা, তাই বলে এমন প্রকাশ? ভাবতেও কষ্ট হয়। পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে ইমরান।ভাতের জন্য হা-হিত্যেশ করে আছে মনে হয়, নাকি তারই জন্যে? দু’চোখে ক্ষুধাতুর লোলুপ দৃষ্টি।পালাবার উপায় নেই নীলার। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী আজও। বন্দিত্ব দশা ঘোচাবার জন্যই কি আকাশের দিকে বার বার তাকাতে ইচ্ছে করছে? খোলা দরজা দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রস্নাত আকাশের আলোকিত জ্যোৎস্নায় অলৌকিক স্বপ্ন ভালো লাগার কথা। অপূর্ব ভালোবাসার কথা মনে করতে চায় নীলা, পারে না।

স্বপ্ন তার খান খান হয়ে গেছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনাটাকে ভুলতে পারে না। স্বপ্নের কথা বলেছিল তিতাস। একই গ্রামেরই ছেলে। একই কলেজে পড়ত ওরা। দেখা হত, কথা হত। আনন্দের পুলকিত বন্যায় ভেসে যেত ওরা। এমন সময় দেশজুড়ে ভয়াল বিভীষিকাময় যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর ভয়ে সবাই তখন পালাচ্ছে। তিতাসরা যাচ্ছে যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে। ওরা পালাতে জানে না। জনযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দেশ উত্তপ্ত। মু্ক্তিকামী ছেলেরা ক্ষিপ্ত। নরপিশাচ দানবরূপী ইয়াহিয়ার শুয়োরমুখো সৈন্যদের তাড়াবার জন্যে, মারবার জন্যে তিতাসরা নিয়েছে মরণপণ প্রতিজ্ঞা।আরেকটি ছোট্ট প্রতিজ্ঞা করল তিতাস। হঠাৎ করেই ওদের বাড়িতে এল একদিন। ওদের বাড়ির সবাই চিনত তিতাসকে। নীলাকে বলল, যুদ্ধে যাচ্ছি নীলা। ফিরে আসবে বিজয় নিয়ে। একটু হেসে বলেছিল, নীলা আসব তোমাকে জয় করার জন্যে। দ্বিতীয় বিজয় হবে এটি। তারপর চলে গিয়েছিল তিতাস। কতদিন হলো তিতাস গেছে? মনে করতে চায় নীলা। ঠিক পারে না। শুধু মনে হয়, অনেকদিন। অনেকদিন দেখে না তিতাসকে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। তিতাস এখন যুদ্ধ করছে কোথায়, কে জানে। মনে মনে প্রার্থনা করে নীলা, তিতাসের প্রথম বিজয়টা যেনো অর্জিত হয়। তিতাসদের মতো ছেলেদের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আসুক, দেশের মানুষ মুক্ত হোক। তিতাস তো জানে না, দ্বিতীয় বিজয়টা দেখার আর ভাগ্য হবে না তার। আবার মনে মনে ভাবে নীলা, তা কেন হবে? নীলাকে তো জয় করেই গেছে তিতাস। কেউ না জানুক, ওরা দু’জন তো জানে। এটাই পরম সত্য।

শুচিস্নিগ্ধ কিছু চিন্তা, একটি স্বপ্ন হোঁচট খায় দারুণভাবে। ভাত পুড়ছে চুলোয়, ওদিকে চিৎকার করছে নীলার শাশুড়ি। হন্তদন্ত হয়ে ভাত নামায় নীলা। এই পোড়া ভাতই এখন তার জীবন। দু’মাসের বিবাহিত জীবনে এটাই বুঝে গেছে নীলা। এর চেয়ে বেশি কিছু আর পাওয়ার নেই। চাওয়ার অনেক কিছু ছিল। তা আজ পলাতক। সব ভুলে যেতে চায় নীলা। সব কিছু ভোলার জন্যই তো নীলার চাচারা জোর করে ইমরানের সঙ্গে বিয়ে দিল অকস্মাৎ। যুক্তি দাঁড় করাল- মেয়ের ইজ্জত বাঁচানোর জন্যে এখন বিয়েটা জরুরি। ইমরানও এই গাঁয়েরই ছেলে। অনেকটা বখাটে গোছের। বরাবরই নীলা ইমরানকে অপছন্দ করে এসেছে। সেই ইমরানের সঙ্গেই তার বিয়ে হয়ে গেল বিনা নোটিশে। নীলার বিধবা মা কিছু বলতে পারলেন না। পরিস্থিতির কারণে নীলাও নিশ্চুপ হয়ে গেল। বড়োভাই দুটো যুদ্ধে গেছে। ছোট ভাইবোন তারা নিতান্তই অবুঝ। প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিল না নীলার পক্ষে। নীলাই পারত প্রতিবাদ করতে।অসাড় যুক্তিকে কারণ দেখিয়ে খণ্ডন করার চেষ্টা করতে পারত। বিবাহিত ও দু’ছেলের মা মরিয়ম বু-র কথা তুলতে পারত। মিলিটারিদের ক্যাম্পে নির্যাতনের পর মরিয়ম বু আত্মহত্যা করেছে। এ কথা সবাই জানে। কিন্তু চাচাদের ভয়ে কিছুই বলতে পারল না নীলা। কাঁদল, শুধু কাঁদল। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে স্বামীর ঘর করতে এল। এ পাড়া থেকে ও পাড়া। চমৎকার নাটক। নাটকের মতোই মনে হয় নীলার কাছে।

নাটক নাটক খেলা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল নীলার টানাপড়েনের জীবন। স্থবির যুদ্ধ। যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকে খবর পায় নীলা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনার সৌভাগ্য তার হয় না। এ বাড়িতে ওসবের পাট নেই। তিতাসদের বিজয় নাকি আসন্ন। শীতার্ত দিনের হীম শীতল ক্লান্তির মতো অবসন্ন শরীরের গ্লানিকে তাড়াতে চায় নীলা। পুলকিত হতে চায় আসন্ন একটি মহান বিজয়ের কথা ভেবে। উত্তপ্ত হতে চায় আবেগের ঘনঘোরে। শরীরের প্রতিটি তন্ত্রী এখন সজাগ নীলার। বিজয়ের ধ্বনি শোনার প্রত্যাশায় ব্যাকুল নীলা। এমন সময় ঘটে গেল ঘটনাটি। নাকি দুর্ঘটনা? কিছুই বুঝতে পারে না নীলা। এমন কেন হলো? নীলার ইজ্জতের জন্য বড়োই চিন্তিত ছিলেন চাচারা। সেই চাচারা কিছুই তো করতে পারলেন না। ঠেকাতে পারলেন না ভয়াবহ অমানিশাকে।

পাকিস্তানি মিলিটারিদের শেষ মরণ কামড়টুকু যেন নীলার জন্যেই তোলা ছিল। বর্বর পশুদের লালসার শিকার হলো নীলা। মিলিটারিদের ক্যাম্পে অসহ্য নিপীড়ন আর নির্যাতনের পর অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল নীলার ছিন্নভিন্ন শরীরটা। অনেকেই দেখল। কেউ এগিয়ে এল না। তেমন কেউ ছিল না। নীলা এখন অশুচি। অনেক যন্ত্রণা নিয়ে উঠে দাঁড়াল নীলা। ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে জড়াল পরম মমতায় নিজের শুচিস্নিগ্ধ শরীরটা। হঠাৎশরীরের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল নীলা। না, না, সে তো এখন শুচিস্নিগ্ধ নয়, সে অশুচি হয়ে গেছে। সত্যিই কি অশুচি হয়ে গেছে নীলা? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এল বাড়িতে। ইমরানের কাছে। আঁতকে উঠল ইমরান। তার স্বামী। তার ইজ্জত বাঁচানো যার নাকি দায়িত্ব ছিল। স্বামী বলল, শ্লেষভরে পরম ঘৃণায়, ছি: কোন সাহসে এসেছ এখানে? যাও, বেরিয়ে যাও। নষ্ট মেয়ে মানুষ।

বেরিয়ে এল নীলা। শাশুড়ির তিরস্কারের জন্য আর দাঁড়াল না। মায়ের কাছে এল। মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ছোট ভাইবোনের চোখেও সাগরভাঙা জল। কিন্তু ওরা নিরুপায়। মাথার ওপর আছেন চাচারা। ওনারাই তো মূল অভিভাবক! চেঁচাতে চেঁচাতে এলেন তারা। বললেন, তোর কি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই? বের হয়ে যা। তোর মুখ দেখাও তো পাপ। মরণ হয় না তোর? মনে পড়ে নীলার, তার স্বামীও তাকে মরতে বলেছে। মরণটাই এখন জরুরি। চমকে উঠে আবার নিজের দিকে তাকালো নীলা। তার পাপবিদ্ধ শরীরের দিকে। সত্যিই তো! তার কাণ্ডজ্ঞান কি একেবারেই লোপ পেয়েছে? পথে নামল নীলা। একা। বড় একা। আর পেছন ফিরে তাকাল না। কিন্তু মরতে পারল না নীলা। অমাবস্যার জীবন নিয়ে এখনো বেঁচে আছে নীলা। অমাবস্যা তো তার জীবনে আগেই এসেছিল, তাতে যুক্ত হয়েছে কিছু কলঙ্কের কালিমা। আরও গাঢ় হয়েছে অমাবস্যার কালো অন্ধকার। একগুচ্ছ বেদনার অন্ধকার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আর হাঁটে না নীলা। ঋজু হয়ে দাঁড়াতে শিখেছে। জনযুদ্ধে সমর্পিতা একজন নারী। একটি মানুষ।

অনেক দিন হয়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাবতে আনন্দ লাগে, ওদের জন্যেই তো দেশ স্বাধীন হয়েছে। আকাশ আরও নীল হয়েছে গভীর খুশিতে। বাতাস মাতাল হয়েছে পরম পাওয়াতে। বিজয়ের গান গায় পাখি, ঘাস, ফুল। চারিদিকে আনন্দের বন্যা। তিতাস এখন কোথায় জানে না নীলা। তিতাসের কথা ভেবে, একটি স্বাধীনতার কথা ভেবে কেটে যায় নীলার জীবন। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করতে করতে মাঝে মধ্যেই থমকে যায় নীলা। দেখতে পায় তিতাসের হাত। পরম নির্ভরতার দুটি হাত। যুদ্ধজয়ী সুদৃঢ় দুটি হাত। দুটি হাত বাড়িয়ে তিতাস যেন বলে, এসো নীলা। তোমার জন্য আমি গর্বিত। তোমার শুচিস্নিগ্ধ রূপ দেখার জন্যেই আমি এসেছি। চারিদিকে আলো। কোথাও অন্ধকার নেই। চেয়ে দ্যাখো, আকাশ তোমায় ডাকছে। পৃথিবী তোমাকে চায়। আমিও তোমাকে চাই। এসো নীলা। সারা শরীরে বিজয়ের আনন্দ মেখে এসো।