১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের বেদনাদায়ক ও কলঙ্কিত এক অধ্যায় – হীরেন পণ্ডিত
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রথম সরাসরি সামরিক বাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট মধ্যম ও নিম্নসারির অফিসার ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপ ছিল। তবে এর পরের ইতিহাস ভিন্ন। এই হত্যাকা-কে বাংলাদেশে একটি আদর্শিক মোড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্লেষকরা একমত যে এটি নিছক একটি হত্যাকা- নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হত্যা মামলার রায়ে সংক্ষেপে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথাও বলা হয়েছে।
যাই হোক, নির্মম হত্যাকাণ্ডের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তৎকালীন রাজনীতিবিদদের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি
বিচারের পরেও অস্পষ্ট ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, এটা মোটেও সহজ কাজ নয় যে, কিছু সংখ্যক সেনা সদস্য জাতির পিতাকে তাদের পরিবারসহ নিরস্ত্র মানুষদের ট্যাঙ্ক নিয়ে গিয়ে সপরিবারে হত্যা করবে পাশাপাশি রেডিও এবং টেলিভিশনে গিয়ে জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর দেবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী নেতা।
জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে অনেক কিছু করেছেন, জীবনে বেশিরভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরব যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মূলত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন প্রদানের কারণে তারাও পরাজিত হয়েছিল। অন্যদিকে, সারা বিশ্বে স্নায়যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার চলছিল। বিশ্ব রাজনীতি তখন অশান্ত।
বঙ্গবন্ধু আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি বিশাল ফ্যাক্টর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই কোল্ড ওয়ারের শিকার।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ফলে উপমহাদেশের রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। গবেষকদের মতে, মুজিব হত্যার দু’টি মাত্রা রয়েছে। একটি
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অন্যটি আন্তর্জাতিক। বিচারে এর কোনোটাই আসেনি। দেশের প্রথাগত আইনে অন্যান্য দশটি হত্যার মতোই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পটভূমি প্রসঙ্গে তেমন কিছু উঠে আসেনি।
ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রের আত্মাকেই হত্যা করতে চেয়েছে। হত্যা করে জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্র্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে। সামরিক শাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের চার নীতিকে অবমাননা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু বিচারে ষড়যন্ত্রের কথা উঠে আসেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস
হত্যাকাণ্ডের পর, আওয়ামী লীগের জন্য একটি কঠিন সময় ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয় যাতে কেউ আওয়ামী লীগের হাল ধরতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যার জন্য, দলের চার জাতীয় নেতাকেও ৩রা নভেম্বর কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দলের নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত ছিলেন। প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। নেতৃত্বের অস্থিরতা ছিল। নেতৃত্বের কাপুরুষতা ছিল। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।
সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয় সেই সময়ে । চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়।
এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা রোধের আহবান জানাতে পারেন নি তারপরেও দলের তৃণমূল নেতারা হাল ছাড়েননি। তারা চেয়েছিল
কেউ একজন প্রতিরোধে এগিয়ে আসুক। কিন্তু সেই আহবান জানানোর জন্য কেউ ছিলেন না। ফলে কঠিন হয়েছিলো আওয়ামী
লীগের রাজনীতি।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধের আগুন ছিলো আওয়ামী লীগের হৃদয়ে। সাংগঠনিক কার্যক্রম ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন কাউন্সিলকে ঘিরে সারাদেশে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা ও সংগঠিত হয়েছিল। অধিবেশনে অবিলম্বে সামরিক আইন
প্রত্যাহার এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। তারা কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং ১৫ আগস্ট হত্যাকা- ও জেলহত্যার বিচার দাবি করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি দেশের সংবিধান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর পরাজিত শক্তি, দেশি -বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে হত্যা করা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় দুর্যোগ নয়,
এটি বিশ্বের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর হত্যা করা হয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন নজির নেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার পর সারা বিশ্বে তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে এবং বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বজুড়ে মানুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশ^স্ততা হারায়। বিদেশরা মনে করতো যে বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে, সাহসী বাঙালিরা নিজেদেরকে একটি কাপুরুষ-আত্মঘাতী জাতি হিসেবে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার আত্মঘাতী চরিত্র বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতার চেতনাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। মানুষ মনে করেছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এটা সহজেই বলা যেতে পারে যে, বাঙালি জাতির চেতনার নাম, একটি স্বপ্নের নাম, সৃষ্টির ইতিহাসের নাম, আকাক্সক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সাফল্যের নাম – তাহলে তার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন থাকবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনের অপরাধীরা একদিন প্রকাশ পাবে। তিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এ সময়টুকুতে অনেক নেতা আমরা পেয়েছি এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অবদানও আছে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে
জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের ভাবনা, চেতনা, লক্ষ্য, স্বপ্ন সবকিছু ধারণ করতে পেরেছিলেন একজনই; তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের যে বাড়িটি থেকে তিনি স্বাধীনতার
ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫-সালে ১৫ আগস্টের রাতে সেই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় দুর্যোগ নয়, এটি বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। স্বাধীনতার মহান
স্থপতিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে ও তার স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল, যার কোনো তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যে কোনো
জঘন্য কাজ করতে পারে।
শোকগাঁথা রক্তাক্ত আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এ মাসেই বাঙালি হারিয়েছে তাঁর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে
হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির পিতার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর
সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকা- থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ভগ্নিপতি আব্দুর রব
সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী বেগম আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ
পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন। ভারত বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি. চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’ এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব অকল্পনীয়।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকা-কে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর করে জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। একইভাবে বাঙালির আত্মঘাতী চরিত্রের অপবাদেরও অবসান ঘটেছে। টেলিগ্রাফ পত্রিকার মন্তব্য করে, পত্রিকাটি সেদিন সুদূর প্রসারী মন্তব্য করেছিল। দেশের মানুষ এখন অনুধাবন করতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে দেশে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল।
পচাঁত্তরের পনেরই আগস্ট অভ্যুত্থান সংগঠিত করে শেখ মুজিব এবং তার সহযোগীদের হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, নিজেদের ইচ্ছে মাফিক বেয়নেটের ডগায় রাষ্ট্রপতি বানিয়ে, মন্ত্রীসভা গঠন করে, সরকার গঠন করে সম্পূর্ণভাবে সংবিধান-বিযুক্ত করে সুপার কনস্টিউশানাল কর্তৃত্ব দিয়ে সমগ্র দেশকে সামরিক আইনের আওতায় আনা
হয়েছিল।
১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান মুজিব হত্যা ও ধারাবাহিকতায় ১৫ বছর ধরে এ দেশে যথাক্রমে জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র চলেছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে অবৈধ বলে প্রতিরোধ করা হলে এরপর একের পর এক দুই ডজনেরও অধিক অভ্যুত্থান প্রক্রিয়া ঘটতো না। একের পর এক এত হত্যাকা- হতো না। ১৫ বছর দেশ সামরিক শাসনের কব্জায়
থাকতো না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র কয়েকদিন পর ২৮ আগস্ট দি গার্ডিয়ান লিখেছিল পনেরই আগস্টের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেন বাংলাদেশের
জনগণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা এবং সামরিক শাসনের কালে প্রত্যাবর্তন করেছে। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কয়েক বছর পর ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনেও বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও শেখ মুজিবের হত্যার
পর গণতান্ত্রিক আমলের অবসান হয়। এদিকে, পনেরই আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তা যে
সাংবিধানিক ভাবে বৈধ ছিল না খোদ সরকার প্রধান হিসাবে খন্দকার মোশতাক আহমদও তার প্রথম ভাষণে উল্লেখ
করেছিলেন।
১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে অধিষ্ঠিত হন খন্দকার মোশতাক আহমদ। সামরিক আইনের জবর দখলকারী সরকার প্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও-
টেলিভিশনে তিনি এদিন এক ভাষন দেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়। ভাষণে মোশতাক এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে
রূপদানের পূতপবিত্র কর্তব্য সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য করুণাময়ের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি
হিসেবে সরকারের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তবে, তিনি বলেন, দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সর্ব মহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে
হয়েছে ।
রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়কের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তাঁর চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, আদর্শবোধ-জীবন দর্শন ইত্যাদি আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদানগুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে এবং এক অবস্থান থেকে উন্নতর অবস্থানে সেসবের উত্তরণ ঘটেছে। বিকাশ ও বিবর্তনের এই গতি কোনোদিন থেমে থাকেনি, অব্যাহত থেকেছে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
রাজনীতির দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাকে অনেক প্রতিকূল রাস্তা অতিক্রম করতে হয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় কখনো কখনো বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে; কিন্তু তার সার্বিক বিবর্তনের গতি ছিল সামনের দিকে, প্রগতি অভিমুখে আর কর্মকাণ্ডে ছিল সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।
দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব ছিল না বলেই মনে হতো। তবে এ কথা বলা যায়, বাঙালি জাতি
যদি হয় একটি চেতনার নাম, একটি স্বপ্নের নাম, ইতিহাস সৃষ্টির নাম, আকাক্সক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সফলতার নাম-
তবে তার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই ইতিহাসের মহানায়ক। বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরকাল থাকবেন
অমর হয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক