রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও পাবনাবাসীর নাগরিক সংবর্ধনা । এবাদত আলী

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও পাবনাবাসীর নাগরিক সংবর্ধনা । এবাদত আলী

শেষ পর্ব

পাবনার কৃতিসন্তান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু অতি সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় মৃদু হাসি মুখে দৃঢ়কন্ঠে তার সম্মোহনী বক্তৃতা আরম্ভ করলেন। শুরুতেই তিনি তাঁর সফরসঙ্গী প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীনসহ উর্ধতন সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নাম উচ্চারণ পুর্বক পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি অতি আবেগপ্রবন হয়ে বলেন, পাবনার মানুষ আমাকে এত ভালবাসে তা আমি আগে অনুভব করিনি। তারা রাতদিন আমার জন্য পরিশ্রম করেছেন, চুপ্পু ভাই আসতেছেন, চুপ্পু ভাই আসতেছেন, হায় আল্লাহ আমি কি দিয়ে এই ঋন শোধ করবো।

তিনি বলেন, আমি যখন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে পাবনায় আসছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাতের স্মৃতিসহ আমার মানসপটে ভেসে ওঠেছিলো। রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭২ সালে পাবনায় মুজিব বাঁধ এর উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন আমি পাবনা জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর সন্মানে আয়োজিত জনসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। আমার বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। জনসভা শেষে তিনি হেলিকপ্টারে করে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথম হেলিকপ্টারে চড়েছিলাম তাও বঙ্গবন্ধুর সাথে।

তিনি বলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করেছিলো। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আবার ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ করায় আমি এই পাবনা শহরে প্রতিরোধ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট আমাকে গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনা ক্যাম্পে টানা তিন মাস চলে অকথ্য অমানসিক নির্যাতন। তারপর তিন বছর কারা ভোগের পর ১৯৭৮ সালে আমি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করি।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ম্মৃতি। পাবনার আলো-বাতাস, প্রকৃতি পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের সাথে মিলে মিশে আমি বেড়ে উঠেছি। তাই রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেও আমি আপনাদের ছিলাম, এখনো আমি আপনাদেরই আছি। ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতেও আপনাদের লোক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই। বঙ্গভবনে অবস্থান করলেও পাবনার কথা মনে আসলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আমি ১৯৬৭-৬৮ সালে এই কলেজের ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। পরে ছাত্র লীগের সহ-সভাপতি এবং সভাপতিও হয়েছিলাম। তখন প্রতিকুল পরিবেশে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অনেক ঘাত প্রতিঘাত মোকাবিলা করে রাজনীতি করতে হয়েছিলো। রাজনীতি করার সুবাদেই আমার আদর্শ , আমার নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় হয়।

মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালন কালে বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ করা তদন্তের ভার আমার উপর দেওয়া হয়েছিলো। সেটা ছিলো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমার দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কানাডার আদালতে বিশ্ব ব্যাংকের সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই চাপ মোকাবিলায় আমার প্রতি পাবনাবাসীসহ দেশবাসীর দোয়া ছিলো বলেই এই কঠিন কাজ আমি করতে পেরেছি।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বক্তব্যে আরো বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হবো এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু ভাগ্য আজ আমাকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে। আপনাদের দোয়া আর ভালোবাসা ছিলো বলেই আমি এপর্যন্ত আসতে পেরেছি। আপনাদের ভালোবাসাকে সঙ্গি করেই রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাই।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা প্রভাব থাকা সত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। মানুষের গড় আয়ু ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়নসুচকে বাংলাদেশ পার্শবর্তী অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থানে অবস্থান করছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় ভুমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা চলবে। কিভাবে দেশ চলবে, কিভাবে নির্বাচন হবে সব কিছু সংবিধানেই লেখা আছে। তিনি আরো বলেন, আমি ভেসে আসিনি, রাজপথ থেকেই আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জুলুম নির্যাতন, জেল খেটে আজকে বঙ্গভবনে গিয়েছি। রাষ্ট্রপতি বলেন, ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ ও সমাজের অর্থনীতির জন্য জনকল্যানকর হতে পারেনা বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশ তমাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে এসে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে আমাদের সকলের সহযোগিতা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা হানাহানির অবসান ঘটিয়ে সহিঞ্চু গণতান্ত্রিক রাজনীতি বজায় রেখে সংবিধানকে সমুন্নত রেখে নির্বাচন করতে হবে। মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষ ভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে কোন রকম নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। দেশে সংবিধানের আওতায় নির্বাচন হবে। আইনানুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে ইনশাল্লাহ। রাজনীতির নামে কেউ হানাহানি সৃষ্টি করবেননা। সকলেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী দেশী বিদেশী যে কোন অপশক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাড়াতে হবে। সামনের দিনগুলোতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সকল রকম ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্যকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। জনগণই ক্ষমতার উৎস উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে চলমান এ গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে আজ। এ সরকার বাংলাদেশে মানুষের মুখ উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

পাবনার সন্তান, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সুদীর্ঘ সময় ধরে মনের সকল আকুতি- সকল উচ্ছাস ব্যক্ত করে চলেছেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে পাবনার শহীদ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মিদের নাম উচ্চারণ পুর্বক তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছেন। তিনি সেসময়ের নকশালীদের অকথ্য নির্যাতন ও আওয়ামী লীগ নেতা আহমেদ রফিককে নির্মমভাবে হত্যার কথাও অকপটে তুলে ধরেন। তিনি রফিক হত্যাকারি নকশাল নেতার নাম উল্লেখ করে বলেন সে এখনো জীবিত আছে।

রাষ্ট্রপতির সামনে বসা হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তৃতা শুনছিলেন। পাবনা জেলার ব্যাতিক্রমী এই নেতা যখন পাবনাবাসীর জন্য সুখবর দিতে যাচ্ছিলেন। পাবনাবাসীর দাবী-দাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করেন তখন তিনি বলেন বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করতে চাই। সরাসরি পাবনা-ঢাকা রেল যোগাযোগের কথা বলতেই হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় শুরু হলো। তাঁর জনৈক নিরাপত্তা অফিসার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন করে বল্লেন স্যার আকাশে মেঘ, ঝড় শুরু হয়ে গেছে, বক্তব্য শেষ করতে হবে। তিনি কিছুটা আবেক প্রবন হয়ে বলেন, কিসের ঝড়, ঝড় তো আমিই উঠাচ্ছি, বলেই দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই পাবনা থেকে সরাসরি ঢাকা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হবে। তখন প্রচন্ড ঝড়ো-হাওয়ার মাঝে মুহুর্মূহ করতালিতে মুখরিত অনুষ্ঠানস্থল। তিনি আরো কিছু দাবী-দাওয়ার পুরনের ব্যাপারে বলার জন্য বক্তৃতা চালিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এরই মাঝ দিয়ে পাবনার নাগরিক সংবর্ধনা আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।

(সমাপ্ত)।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট